প্রফেসর মোশতাক আহমদ

ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা এক নির্জন আরন্যাক দুপুর। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগে। থেমে গেছে ছেলেমেয়েদের কলকোলাহল। উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছি বাইরের অবারিত শ্যামল প্রকৃতির পানে। পত্র পল্লবের আড়াল থেকে করুন সুরে একটানা ডেকে যাচ্ছে স্বজন হারা এক ঘুঘু। তন্ময় হয়ে ভাবছিলাম স্বপ্নিল-বর্ণিল মুছে যাওয়া দিনগুলোর কথা। কেন এক অব্যক্ত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে দেহ মন। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলাতে গিয়ে ব্যর্থতার পাল্লাটাই যেন ভারি হয়ে উঠছে। কবি গুরুর বেদনার্থ উচ্চারণ অনুরণিত হচ্ছিল হৃদয়ের গহীন গহনে ঃ

‘তুই শুধু ছিন্ন বাধা পলাতক

বালকের মত

সারাদিন বাজাইলি বাঁশি’

এমন এক অপার্থিব মুহূর্তে যখন আমি মগ্ন চৈতন্য তখন হঠাৎ করে সরে গেলো দরজার পর্দা। ভেতরে ঢুকে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়লেন এক সুদর্শন যুবক। তাঁর পেছনে পেছনে আমার অফিস কক্ষে ঢুকলেন আমারই স্কুল জীবনের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, কক্সবাজারের বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব (এখন মরহুম) আবুল কাশেম সাহেব। যুবকের পরনে সাদামাঠা পায়জামা পাঞ্জাবী, চোখ দুটো মর্মভেদী প্রদীপ্ত প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে দিদীপ্যমান। মুখের দিকে তাকাতেই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পরিচয় দিলেন ‘আমি খালেকুজ্জামান’।

স্মৃতির দুয়ার খুলে গেলো আকষ্মাৎ। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো পুরানো ঢাকার অভয় দাশ লেইনের সেই লাল ইটের বাড়িটি। ও বাড়ীতে সপরিবারে বাস করতেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী জনাব (মরহুম) মৌলভী ফরিদ আহমদ। যিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান লেজিসলেটিভ এসেম্বিলির সদস্য। আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পূর্ব পরিচয় সূত্রে ছুটির দিনে আমরা সে বাসায় যেতাম আর গল্প গুজবে সারাটা বেলা কাটিয়ে খাওয়া দাওয়া করে বিকালে ফিরে আসতাম হলে।

জনাব ফরিদ আহমদ অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে। বিশেষ করে তার সহধর্মিনী রিজিয়াবুর স্নেহের পরশ আমার সে দূর প্রবাস জীবনে মায়ের কথা সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দিত। খালেক সেই ফরিদ-রিজিয়া দম্পতির স্নেহের দ্বিতীয় সন্তান। তরুণ আইনজীবী, আইন ব্যবসা শুরু করেছেন হাইকোর্টে। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান। ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে।

খালেককে দেখেছি তাঁর শৈশবে। আজ সুদীর্ঘ দিন পর তাঁকে দেখে এক অভাবনীয় অনুভূতিতে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তাঁদের বাসায় গেলেই গেইটের সামনে আমাদের প্রথম দেখা হতো তাঁর সাথে। সম্ভাষণ জানানোর জন্য যেন অপেক্ষা করে আছেন। লজেন্সের ছোট প্যাকেটটি হাতে তুলে দিতেই সে দিতেন ভোঁ দৌড়, আর তৃপ্তির হাসি হেসে মাকে জিজ্ঞেস করতেন, বলো তো মা, আমার মুঠোয় কি? সেই খালেক বাল্য কৈশোরের চৌকাঠ পেরিয়ে আজ ভরা যৌবনে পদার্পন করেছেন। তিনি আজ (তখন) কক্সবাজার রামু নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন মায়ের নির্দেশ আমার সাথে যেন অবশ্যই দেখা করে। পরামর্শ চাইছে নির্বাচনী প্রচারণায় কিভাবে নামবেন। দীর্ঘদিনের ব্যবধান। দেখা সেই কবে তাঁর ছেলে বেলায়। তাঁর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা কিংবা কর্মকান্ড সম্বন্ধে আমার জানা নেই কিছুই। আমার কাছে চাইছেন পরামর্শ। কিইবা বলি তাঁকে।

তাঁর অসামান্য বাক বৈদগ্ধ্য আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও গভীর জ্ঞান দেখে বুঝতে বাকি রইলো না, এ যুবকের মধ্যে সুপ্ত আছে এক অসীম সম্ভাবনা। তাঁকে শুধু বললাম, মামা, আপনি এলাকায় নবাগত। এলাকার আম জনতার সাথে আপনার কোন পূর্ব পরিচয় নেই। জনতার কাছে যান। তাদের সাথে পরিচিত হন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা আপনাকে ফিরিয়ে দেবে না। আমার প্রতীথি জন্মেছিল জনগণ এ যুবকের আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এলেই বুঝতে পারবে এ সেই ব্যক্তিত্ব যিনি পারবেন তাদের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে জাতীয় রাজনীতিতে।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলো। স্বল্প ভোটের জন্য খালেক জিততে পারলেন না। স্বভাবতই মুষড়ে পড়লাম। নির্বাচনের পর আবার তাঁর সাথে দেখা। হাস্যোজ্জ্বল সেই মুখ-চোখ। নির্বিকার ও শান্ত কন্ঠেই বললেন, মামা, এবার হেরে গেলাম।

তাঁকে তো সান্তনা দেয়া যায় না। এ যুবক তো সে ধাতব নয়। তবুও আড়ষ্ট কন্ঠে বললাম, Cheer-up, my boy| আপনি রাজনীতিতে নবাগত। হয়তো জনতার বৃহত্তর অংশের কাছে সময়ের স্বল্পতার কারণে পৌঁছাতে পারেননি। ফলাফল বিশ্লেষণে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে জনতা আপনাকে আগামীতে ফিরাবে না। জনতার পাশে থেকে জনতাকে সাথে নিয়ে আপনার কর্মকান্ড চালিয়ে যান। জনতা নিরাশ করবে না। এলো ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচন, জনতার রায় গেলো তাঁর পক্ষে। বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন খালেক।

নির্বাচনোত্তর তাঁর জন সংযোগের এক পর্যায়ে এলেন রামু কলেজে। সবার সাথে কোলাকুলি। ঠোঁটে লেগে আছে সেই অলৌকিক হাসির রেখা। বললাম, Khaleque, never forget your people, মাথা নেড়ে সায় জানালেন খালেক। জনতাকে ভালবেসেছিলেন খালেক। জনতাও তাঁকে বিনিময়ে দিয়েছে অফুরন্ত ভালবাসা। এযাবৎ কক্সবাজার রামু এলাকায় জনতার এতো কাছে কোন নেতা এসেছেন কিনা আমার জানা নেই।

সংসদে গিয়েই চমক সৃষ্টি করলেন খালেক। সাংসদ হিসেবে জীবনের প্রথম বক্তব্য দিয়েই দৃষ্টি কাড়লেন সমগ্র জাতির। দেশের মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারালো, বাংলার ভাগ্যাকাশে উদিত হয়েছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

তাঁর দল তখন বিরোধী আসনে। এলাকার উন্নয়নে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছেন না। এ মর্মজ্বালা তিনি মাঝে মাঝে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। তারপরও তাঁর সীমিত সাধ্যের মধ্যে জনগনের কল্যাণে, এলাকার উন্নয়নে যা করে গেছেন তা তাঁর প্রবর প্রতিপক্ষও নির্দ্বিধায় স্মরণ করে। স্থানীয় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদের উন্নয়নে রেখে গেছেন এক অবনদ্য অবদান। রামু কলেজ, কক্সবাজার সিটি কলেজ ও ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ কলেজ, রামু হাই স্কুল, নাদেরুজ্জামান হাইস্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে তিনি পালন করেছেন প্রশংসনীয় ভূমিকা।

কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য তিনি প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন কর্তৃপক্ষকে। আর তাঁর সে মহতী উদ্যোগের সুফল ভোগ করছেন এলাকাবাসী। আজ বেশ কিছু স্কুল-কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে।

যতদূর জানি তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী ও সফল কম্পিউটার বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে কম্পিউটার শিক্ষার বিস্তার তথা কম্পিউটার এর ব্যাপক ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অবকাঠামো সৃষ্টিতেও তাঁর ছিল প্রবল আকাঙ্খা। পেশাগত জীবনে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি অনেক অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনা করে তাদেরকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে গেছেন। দুঃস্থ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা স্পর্শ করে যেতো তাঁর কোমল হৃদয়, মানুষের দুঃখের কথকতা শুনতে শুনতে তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে যেতেও দেখেছি।

পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করার দুর্লভ সুযোগও তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল। বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে এক উদার ও আধুনিক মনের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা সুশীল সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তাঁর আলাপচারিতার মধ্যে এ প্রত্যয় ফুটে উঠতো। সময় পেলেন না তিনি। আশৈশব লালিত স্বপ্নের সফল রূপায়ন দেখে যাবার সৌভাগ্য হলো না তাঁর। অথচ তাঁর মূখে উচ্চারিত হতো Robert frost এর অমর বাণী ঃ

The woods are lovely

dark and deep

But I have promises to keep

And miles to go before I sleep

And miles to go before I sleep.

খালেক নেই। বেঁচে আছে তাঁর স্মৃতি। খালেক, তোমর র্কীতির চেয়ে তুমি যে মহৎ। জনগণ হারিয়েছে এক মহান ব্যক্তিত্বকে, উল্কার মতো ছিল যার উত্থান আর উল্কার মতো ছিল যার তিরোধান। তাঁকে আর দেখা যাবে না ছুটে যেতে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর দেখা মিলবে না দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত এক মানুষকে। কবি গুরুর চিত্তে যে নশ^রতার চেতনা বারে বারেই বাঙ্খময় হয়ে উঠেছে তাঁরই যেন প্রতিফলন পাই খালেকের জীবনে, তার জীবনাচরণে ঃ

‘স্ফুলিঙ্গ তার ক্ষণকালের

পাখায় পেল ছন্দ,

উড়িয়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল

এই তারই আনন্দ’।

প্রচার বিমুখ এ যুবক ছিলেন অত্যন্ত ধীশক্তির অধিকারী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর মেধার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Business Administration থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে পাশ করেন MBA, IUBAT এর একজন সফল শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেছেন। LLB পরীক্ষাতেও তিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সদালাপী, নিরহংকার, সহজ সরল এক দুর্লভ ব্যক্তিত্ব খালেকুজ্জামান। মানুষকে সহজে আপন করে নেবার এক সহজাত ক্ষমতা ছিলো তাঁর।

মনে পড়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে রামু উপজেলা মিলনায়তনে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে উপজেলা কর্তৃপক্ষ সব দলের নেতা এবং এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সভা আহ্বান করে। আমন্ত্রিত ছিলেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধি¦তাকারী সকল প্রার্থী। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এর উপস্থিতিতে সভা আরম্ভ হয়। প্রার্থীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেবল খালেক।

তাঁর বক্তব্যে তিনি বললেন, আমি সন্ত্রাসে বিশ্বাস করি না, আমার দলে সন্ত্রাস নেই। আমার প্রতিপক্ষ জনাব মোস্তাক আহমদ চৌধুরীও একজন ভালো মানুষ। আমি জানি, তিনিও সন্ত্রাসের ঘোর বিরোধী। তাঁর দলও সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয় না। নির্বাচনে ইন্শা আল্লাহ আইন-শৃঙ্খলার কোন বিঘ্ন ঘটবে না। এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে।

কতবড় মাপের মানুষ হলে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর ব্যাপারে এ প্রশংসনীয় মন্তব্য করতে পারেন আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। মানব সেবার মহান ব্রতে উদ্দীপিত ছিলো তাঁর চৈতন্যলোক। শিক্ষায়-দীক্ষায়, চলনে-বলনে, প্রজ্ঞায় মননে খালেক রেখে গেছেন এক স্মরণীয়-বরণীয় দৃষ্টান্ত আগামী প্রজন্মের জন্য।

মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে যে ভালোবাসতে হয় এ সত্যটাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনে। আমার স্বেহেরহাস্পদ খালেক, আমার নেতা খালেক, গণমানুষের আশা আকাঙ্খার মূর্তপ্রতীক খালেক, দুঃখী মানুষের একান্ত আপনজন খালেক আজ আর নেই। অকালেই চলে গেলেন তিনি।

খালেক, তুমি ঘুমাও পরম প্রশান্তিতে, অনন্ত শয়ানে। আমরা তোমার স্মৃতি নিয়ে জেগে আছি এ বাংলায়।